ওমরাহ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মুমিন মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত সম্মানিত ও পূণ্যময়। হজ্জের মতো ওমরাহ করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। নিচে ওমরাহ করার নিয়ম বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
ইহরাম বাঁধা
ইহরাম হলো ওমরাহর প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ইহরাম বেঁধে মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর পথে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেন। ইহরামের নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- ইহরাম বাঁধার স্থান: মিকাত স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। এটি একটি নির্দিষ্ট স্থান যেখানে মুসলিমরা ইহরাম বাঁধেন এবং ওমরাহর জন্য নিয়ত করেন।
- ইহরাম বাঁধার পোশাক: পুরুষদের জন্য দুটি সাদা কাপড়ের টুকরা এবং মহিলাদের জন্য সাধারণ পোশাক, যা শরীরের সমস্ত অংশ ঢেকে রাখে।
- নিয়ত করা: ইহরাম বাঁধার পর ওমরাহর নিয়ত করতে হয়। নিয়ত করার সময় বলা হয়, “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” অর্থাৎ, আমি হাজির আল্লাহ, আমি হাজির।
- তালবিয়া পাঠ করা: ইহরাম বাঁধার পর থেকে মক্কায় প্রবেশ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হয়।
ইহরাম বাঁধার পর মুমিন মুসলমানকে ইহরামের বিধান পালন করতে হয়, যেমন চুল কাটতে, নখ কাটতে, সুগন্ধি ব্যবহার করতে, এবং শিকার করতে নিষেধ।
তাওয়াফ করা
তাওয়াফ হল ওমরাহ করার নিয়ম অন্যতম প্রধান অংশ। এটি পবিত্র কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার ঘুরে সম্পন্ন করা হয়। তাওয়াফের নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- তাওয়াফের শুরু: তাওয়াফ শুরু হয় হাজরে আসওয়াদ থেকে। এটি কাবার একটি কালো পাথর যা চুম্বন করা বা স্পর্শ করা যায়।
- তাওয়াফের দোয়া: তাওয়াফের সময় নির্দিষ্ট দোয়া পড়া হয়। তবে যে কোনো দোয়া বা যিকির করা যায়।
- রামল: প্রথম তিনবার তাওয়াফের সময় দ্রুত চলা বা ছোট ছোট দৌড়ানো হয়। এটি সুন্নাহর অংশ।
- তাওয়াফের শেষ: তাওয়াফের শেষ হয় একই স্থানে অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদে।
তাওয়াফের সময় মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং তাদের পাপ থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন।
Credit: Samay TV
সাফা ও মারওয়া
সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাতবার সাঈ করা হয়, যা হযরত হজের স্মৃতিচারণ। এটি একটি বাধ্যতামূলক অংশ যা ওমরাহর মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। সাঈ করার নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- সাফা থেকে সাঈ শুরু: সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু হয়। এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করা হয় এবং “আল্লাহু আকবর” বলা হয়।
- মারওয়া পর্যন্ত সাঈ: সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত দ্রুত চলা বা দৌড়ানো হয়। মাঝখানে একটি সবুজ আলো থাকে যেখানে পুরুষরা দ্রুত চলে।
- মারওয়া থেকে সাফা ফেরত: মারওয়া পৌঁছানোর পর আবার সাফার দিকে ফেরত যেতে হয়। এভাবে সাতবার সাঈ সম্পন্ন করতে হয়।
সাঈ করার সময় মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং দৃঢ়তা প্রকাশ করেন, যেভাবে হযরত হাজরা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন।
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা
ওমরাহ করার নিয়ম শেষ ধাপ হল মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ যা ওমরাহ সম্পন্নের প্রতীক। চুল ছাঁটার নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- পুরুষদের জন্য মাথা মুণ্ডন: পুরুষদের জন্য পুরো মাথা মুণ্ডন করা সুন্নাহ, তবে কিছু চুল ছাঁটাও যেতে পারে।
- মহিলাদের জন্য চুল ছাঁটা: মহিলাদের জন্য চুল ছাঁটা মানে চুলের এক ইঞ্চি বা কম অংশ কাটা।
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটার পর ইহরাম খুলে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করা যায় এবং ইহরামের সমস্ত বিধান থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ওমরাহ করার নিয়ম প্রতিটি ধাপেই মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য এবং ভক্তি প্রকাশ করেন। ওমরাহ করার সময় মনোযোগ, ধৈর্য এবং বিনম্রতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি পবিত্র ইবাদত যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পন্ন করা হয়।
জমজমের পানি পান করা
ওমরাহ করার নিয়ম সম্পন্ন করার পর জমজমের পানি পান করা একটি সুন্নাহ এবং অত্যন্ত পবিত্র কাজ। এটি হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্য আল্লাহর প্রদত্ত একটি অলৌকিক উপহার হিসেবে বিবেচিত হয়। জমজমের পানি পানের নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- জমজম কূপ: মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামে জমজম কূপ অবস্থিত। এটি অত্যন্ত পবিত্র পানি যা মুমিন মুসলমানদের জন্য বরকতময়।
- নিয়ত করা: জমজমের পানি পান করার আগে নিয়ত করা হয়, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পান করা হয়।
- দোয়া পড়া: জমজমের পানি পান করার সময় দোয়া পড়া হয়। বলা হয়, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসালুকা ইলমান নাফিয়া ওয়া রিযকান ওয়াসিআন ওয়া শিফা’আম মিন কুল্লি দা’ইন” অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমাকে উপকারী জ্ঞান, প্রশস্ত রিজিক এবং সমস্ত রোগ থেকে আরোগ্য দান কর।
জমজমের পানি পান করার মাধ্যমে মুমিন মুসলমানরা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের উন্নতি আশা করেন।
তাওয়াফ-উল-বিদা
ওমরাহ সম্পন্ন করার পর মক্কা ত্যাগ করার আগে বিদায় তাওয়াফ করা হয়। এটি সুন্নাহ এবং আল্লাহর ঘরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রতীক। তাওয়াফ-উল-বিদার নিয়মাবলী নিম্নরূপ:
- তাওয়াফ শুরু: তাওয়াফ-উল-বিদা সাধারণ তাওয়াফের মতোই সম্পন্ন হয়। হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু হয় এবং সাতবার কাবার চারপাশে ঘুরা হয়।
- দোয়া ও যিকির: তাওয়াফের সময় দোয়া ও যিকির পড়া হয়, যা আল্লাহর প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
- তাওয়াফ শেষে দোয়া: তাওয়াফ শেষ করার পর কাবার সামনে দাঁড়িয়ে বিশেষ দোয়া করা হয় এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া হয়।
তাওয়াফ-উল-বিদা সম্পন্ন করার মাধ্যমে মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর ঘরের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী জীবনের জন্য আল্লাহর বরকত কামনা করেন।
Credit: Samay TV
প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ওমরাহ করার জন্য কোন কোন প্রস্তুতি প্রয়োজন?
ওমরাহ করার জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। মুমিন মুসলমানদের ইহরাম বাঁধার জন্য সাদা কাপড় সংগ্রহ করতে হয়, নিয়ত এবং দোয়া মুখস্থ করতে হয়, এবং মক্কা ও মদিনার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এছাড়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় নথি প্রস্তুত করা এবং অর্থ সঞ্চয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ওমরাহর সময় কিভাবে সঠিক নিয়ম মেনে চলা যায়?
ওমরাহর সময় সঠিক নিয়ম মেনে চলার জন্য প্রথমে ইহরাম বাঁধা এবং নিয়ত করা, তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়ায় সাঈ করা, এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটা প্রয়োজন। এছাড়া, তাওয়াফ-উল-বিদা এবং জমজমের পানি পান করাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ধাপে দোয়া ও যিকির পড়া এবং আল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি।
ওমরাহ করার জন্য কোন সময় সবচেয়ে উপযুক্ত?
ওমরাহ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হল হজ্জের মৌসুমের বাইরে। সাধারণত, রমজান মাস এবং হজ্জের পরবর্তী মাসগুলোতে ওমরাহ করার সময় ভিড় কম থাকে। এ সময় মুমিন মুসলমানরা স্বাচ্ছন্দ্যে ওমরাহ করতে পারেন এবং ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারেন।
উপসংহার
ওমরাহ ইসলামের একটি পবিত্র ও পূণ্যময় ইবাদত যা মুমিন মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওমরাহ করার নিয়ম প্রতিটি ধাপ আল্লাহর প্রতি গভীর ভক্তি ও আনুগত্যের প্রতিফলন। ইহরাম বাঁধা থেকে শুরু করে তাওয়াফ, সাঈ, মাথা মুণ্ডন, জমজমের পানি পান করা এবং তাওয়াফ-উল-বিদা পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করা হয়। মদিনায় যিয়ারত এবং ইবাদত করার মাধ্যমে মুমিন মুসলমানরা মহানবী (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।
ওমরাহ করার মাধ্যমে মুমিন মুসলমানরা তাদের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভের আশা করেন। এ অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে একটি স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকে এবং তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করে। ওমরাহ ও মদিনার যিয়ারত একটি পবিত্র এবং পূণ্যময় ইবাদত যা মুমিন মুসলমানদের জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।